বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়কার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা একের পর এক লাশ ভ্যানে তুলছেন। ময়লা চাদর আর ব্যানার দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন লাশগুলো। ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের এই ভিডিও দেখে শিউরে উঠছেন মানুষ। এমন নৃশংসতা দেখে বাকরুদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও।
ভিডিওটি দেখে শনিবার (৩১ আগস্ট) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে একটি পোস্ট দিয়েছেন তিনি। পোস্টে ফারুকী লিখেছেন, ‘মেরুদণ্ড শীতল করে দেয়া যেসব ডিটেইল বের হয়ে আসছে ধীরে ধীরে তাতে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়।’
এই নির্মাতা আরও লেখেন, ‘যে সরকারের শপথ ছিল নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার, সে সরকারই যদি ক্ষমতার জন্য লাশের স্তূপের উপর বসে নৃত্য করে, এর চেয়ে ভয়ংকর আর কি হইতে পারে? ভ্যানের ওগুলা যেনো মানুষের লাশ না, এক দলা মাংসপিণ্ড যেগুলা কোথাও বিলং করে না, কারো ভাই হয় না, সন্তান হয় না। যেনো তাদের অপেক্ষায় কোনো বাড়ীতে কেউ বসে নাই। কি বিভৎস ক্ষমতার এই লোভ!’
ফারুকীর সেই পোস্টের মন্তব্যের ঘরে এবং পোস্টটি শেয়ার করে নেটিজেনরা অপরাধীদের বিচার চেয়েছেন। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।
জানা যায়, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সাভারের আশুলিয়ায় নির্মম এই ঘটনা ঘটে। সরকার পতনের আগমূহুর্তে ছাত্র-জনতা আশুলিয়া থানার সামনে জড়ো হলে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। আন্দোলনকারীদের অনেকেই তখন ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরে পুলিশ নিহতদের একটি ভ্যানে করে অন্য স্থানে নিয়ে যায়।
বীভৎস, রোমহর্ষক
ভিডিওতে পুলিশের ভেস্ট আর হেলমেট পরিহিত যাদের দেখা গেছে, তাদের এক জন ঢাকা উত্তরের গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা আরাফাত হোসেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর আত্মগোপনে চলে গেছেন তিনিসহ ভিডিওচিত্রে থাকা পুলিশের সদস্যরা। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে ইত্তেফাককে জানিয়েছেন, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহম্মেদ মুঈদ শিমুল। তিনি বলেন, চার সদস্যের কমিটিকে দ্রুত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ভিডিও দেখার পর আমরা প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত শনাক্ত করেছি। দ্রুতই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযুক্তরা বর্তমানে পলাতক রয়েছে বলে জানান এসপি।
ছবির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে ঢাকা উত্তর (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বিপ্লব ছবিটি আরাফাতের বলে নিশ্চিত করেন। আরাফাতের গ্রামের বাড়ি বরিশালে। প্রায় দুই বছর আগে তিনি ঢাকা জেলার গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেন। তার বাবা মো. আরিফ হোসেন বদরটুনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এবং হরিনাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বিপ্লব বলেন, এই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর আরাফাত মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। সেদিন কার নির্দেশে ডিবির টিম আশুলিয়ায় দায়িত্বে ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বিপ্লব বলেন, ঢাকা জেলা পুলিশের এসপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত আব্দুল্লাহিল কাফীর নির্দেশে সেদিন এ ঘটনা ঘটে।
সেদিনের কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, গত ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরপর বাইপাইল এলাকার বিজয় মিছিল বের হয়। বিকেলে উত্তেজিত জনতা আশুলিয়া থানা ঘেরাও করে। এ সময় আশপাশে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে থানা ভবনে ঢুকে গেট বন্ধ করে দেন। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আন্দোলনকারীরা চারদিক থেকে থানা ঘিরে ফেলে ও ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। কেউ কেউ গেট ভাঙতে এগিয়ে যান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এ এফ এম সায়েদ আহমেদ পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র রেডি করতে বলেন। এতে আন্দোলনকারীরা আরো চড়াও হন। ঐ সময় থানা ভবন থেকে বেরিয়ে এসে ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ সদস্য থানার গেটে অবস্থান নেন। ওসি উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করলে তারা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে ওসি পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র হাতে নিয়ে রেডি হতে বলেন। জবাবে আন্দোলনকারীরা পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। তখন ওসি সায়েদ আহমেদ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা হেরেছি। আপনারা জিতেছেন। আমাদের মাফ করে দেন। সবাই বাড়ি ফিরে যান।
এর একপর্যায়ে এসআই মালেক, ডিবির ওসি (তদন্ত) আরাফাত, এসআই আফজালুল, এসআই জলিল ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়েন। গুলিতে থানার গলিতে কয়েক জন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। মুহুর্মুহু গুলিতে আন্দোলনকারীরা দৌড়ে পালিয়ে যান। থানার সামনের বিল্ডিং থেকে পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রনি আহমেদ নামের এক ব্যক্তি বলেন, বিকালে থানা ফটকের সামনে উত্তেজিত জনতার ওপর পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে থানার গেটের সামনেই ১০ থেকে ১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। কয়েক মিনিট ধরে ওখানে গোলাগুলি চলে। পরে জীবিত কয়েক জনকে নিচু হয়ে এসে ছাত্ররা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। তারপরও ছয় থেকে সাত জন ওখানে পড়েছিল। তখন আশপাশের সব অলিগলি জনগণ ঘিরে ফেলে। রাস্তা থেকেও লোকজন থানার দিকে রওনা হয়। পরে থানা থেকে সব পুলিশ সশস্ত্র হয়ে একযোগে গুলি করতে করতে বেরিয়ে যান।
রনি আহমেদ আরো জানান, ভ্যানে লাশের স্তূপ করা জায়গাটি পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার ফ্যামিলি কোয়ার্টারের গেটে। ঐ গেটের অন্যপাশে সাদিয়া রাজশাহী কনফেকশনারি অ্যান্ড মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক ফাহিমা আক্তার জানান, ঘটনাটি আমার দোকানের সামনেই ঘটেছে। ৫ আগস্ট বিকালে সাড়ে ৪টা হবে। সেদিন গুলি খেয়ে থানার সামনে পড়ে থাকা মরদেহগুলো ভ্যানে তুলছিলেন পুলিশ। আমাদের চোখের সামনেই তুলেছে। প্রথমে লাশগুলো তুলে ব্যানার দিয়ে ঢেকে থানার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়।
আশুলিয়া থানার সামনে ঐদিন প্রাণ হারানোদের মধ্যে ছিল মধ্য জামগড়া শাহিন স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আসশাবুর। তার বড় ভাই রেজওয়ানুল ইসলাম বলেন, আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে থানার পাশেই রাস্তায় পড়েছিলেন। পরে পুলিশ তার নিথর দেহ রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পিকআপে ঢুকিয়ে আগুন দিয়ে দেয়। ভাইটি আমার জীবিত ছিল, নাকি মৃত সেটা জানার সুযোগও আমাদের হয়নি। আমার ভাইয়ের গায়ে নীল গেঞ্জি ছিল। আমরা গেঞ্জি দেখে পোড়া লাশ শনাক্ত করি। এছাড়া ভ্যানে থাকা লাশের চার জনের পরিচয় মিলেছে। তারা হলেন—সাজ্জাদ হোসেন সজল, তানজিল আহমেদ সুজয়, বাইজিদ ও সবরু হুমায়ুন। হতভাগ্যদের মধ্যে ছিলেন সাভারের আশুলিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়া স্কুলছাত্র সবরু (১৬)। তিনি আশুলিয়ার জামগড়া শিমুলতলা এলাকার বাসিন্দা এনাফ নায়েদের ছেলে। সবরু স্থানীয় শাহীন স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন।
বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডের এক জন অটোরিকশাচালক বলেন, পুলিশ থানা থেকে মেইন রোডে এসে ডান-বাম দুই পাশেই গুলি চালায়। গুলি চালাতে চালাতেই তারা নবীনগরের দিকে এগোতে থাকে। তখন মানুষ জীবন বাঁচাতে যে যার মতো দৌঁড়ে পালিয়েছে। এক মিনিটের জন্যও পুলিশ গুলি বন্ধ করেনি। যতক্ষণ হেঁটেছে ততক্ষণই তারা গুলি ছুড়েছে। রাস্তার দু’পাশে পথচারী, বাসাবাড়ি ও দোকানপাটের শত শত মানুষ ঐদিন গুলিবিদ্ধ হয়। এমন দিন কখনো দেখেনি বাইপাইলবাসী।