
যশোরের কেশবপুর উপজেলার গৌরীঘোনা ইউনিয়নে ভদ্রা নদীর পূর্বাঞ্চল তীরে ভরত ভায়না গ্রাম। এ গ্রামে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরাকীর্তি, যা স্থানীয় জনপদের কাছে ভরতের দেউল বা ভরত রাজার দেউল নামে পরিচিত।
ধারণা করা হয় ৭-৯ শতকে নির্মিত যশোরের কেশবপুরে ভরত ভায়নায় ভর্তের দেউলটি (বৌদ্ধমন্দির) নির্মাণ করা হয়। মন্দিরটি দেখতে এক সময় দেশি বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত থাকলেও বর্তমানে এখানে আসা-যাওয়ার একমাত্র সড়কটিতে যান ও মানুষ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়াসহ হোটেল-মোটেলের ব্যবস্থা না থাকায় দিন দিন আগ্রহ হারাচ্ছে পর্যটকরা। এলাকাবাসী ও পর্যটকদের দাবি-বৌদ্ধমন্দিরে আসা-যাওয়ার ভাঙা সড়কটি দ্রুত সংস্কারসহ আগতদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলে মানুষের আনাগোনায় আবার মুখরিত হয়ে উঠবে দেউলটি। পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক কালীপদ নাথ দীক্ষিত ১৯২২-২৩ সালে যশোরের কেশবপুর উপজেলার ভরত ভায়না গ্রামে অবস্থিত ভরত রাজার ঢিবির রহস্য জানতে ঢিবির জরিপকাজ পরিচালনা করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৪-৮৫ এবং ১৯৯৬ থেকে ২০১৬-১৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খননকাজ পরিচালনা করে। প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা প্রাচীন এ নিদর্শনে ব্যবহৃত ইট ও পোড়ামাটির মূর্তি গবেষণা করে ধারণা করেন, এটি খ্রিষ্টীয় ৭-৯ শতকে নির্মিত একটি মন্দির। বৌদ্ধমন্দির স্থাপত্যের পরিভাষা অনুসারে এ ধরনের মন্দির সবেতিভ শৈলীর বলে চিহ্নিত করা হয়।
ধারণা করা হয়, ভারতের সোমপুর, মহাবিহার, শালবন বিহার, বিক্রমশীলা ও মহাবিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরের ভূমি নকশা এই মন্দিরের অনুরূপ, যা পরবর্তী সময়ে এই মন্দির স্থাপত্যকে প্রভাবিত করেছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত এটিই একমাত্র সবেতিভদ্র ধরনের মন্দির। এর মূল স্থাপনার চারপাশে রয়েছে প্রায় তিন মিটার প্রশস্ত প্রদক্ষিণ পথ।
সাম্প্রতিক খননের ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, এর স্থাপত্য কাঠামোটির গঠনে দুই-বা ততোধিক কালপর্বের রূপান্তর ঘটেছিল। প্রথমকাল পর্বের দিকে সম্ভবত প্যানেল অলংকরণসহ একদিকে প্রবেশপথ বিশিষ্ট বর্গাকার একটি স্থাপত্যকাঠামো নির্মাণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এর প্যানেলসহ ঐ বর্গাকার স্থাপত্য কাঠামোটির চারদিকে চারটি অভিক্ষেপযুক্ত করায় ক্রুশাকৃতির স্থাপত্য কাঠামোয় রূপান্তরিত হয়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ভরত ভায়না দেউলে কর্মরত ওয়ার্কচার্জ মো. সফিয়ার রহমান বলেন, ভরতের দেউলের খননকাজ শুরু থেকে ৩৯ বছর ধরে এখানে কর্মরত আছেন। এই পুরাকীর্তি দেখতে প্রচুর দর্শক এখানে আসে। কিন্তু এখানে আসা-যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটির বর্তমানে বেহাল। কোনো যানবাহন আসতে পারে না। এছাড়া এখানে পর্যটকদের থাকা খাওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নেই। সড়ক সংস্কারসহ হোটেল- মোটেলের ব্যবস্থা করলে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের শত শত পর্যটক এখানে আসবে। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় ফিল্ড অফিসার মোছা, আইরিন পারভীন বলেন, ১৯৮৪ থেকে ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ভরতের দেউলের খননকাজ করে। ঢিবির চারপাশে সীমানা পিলার নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন, ভরতের দেউলটি ১৯৮৪ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় আনা হয়। পরবর্তী সময়ে খননকালে এখানে মানুষের দেহাবশেষসহ বিভিন্ন পুরোনো জিনিসপত্র পাওয়া গেছে, যা দেউলের যাদুঘরে সংরক্ষিত করা আছে। ধারণা করা হয়, এই বৌদ্ধ মন্দিরটি ৭-৯ শতকে নির্মাণ করা হয়। ক্রমেই এটি একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলা হবে।